আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন
আল্লাহ তায়ালা অমুখাপেক্ষি আর বান্দা সর্ব হালতে আল্লাহর মুখাপেক্ষি। বান্দার কর্তব্য হল স্বীয় রবের কাছে সর্বাবস্থায় নিজ মুখাপেক্ষিতাকে প্রকাশ করা। দুনিয়া বড় দুর্গম, পিচ্ছিল ও কন্টকময়। রবের কাছে পৌঁছাতে এই পথে অনেক বেশি হোছট খেতে হয়। কখনও জ্বিন শয়তান, কখনও মানুষ শয়তান, কখনও নাফছ শয়তান কখনও বা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা যেন এই পথ থেকে দূরে সরাতে চায়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠে মানযিলে মাকছুদে পৌঁছানোই হল কামিয়াবী। নিজস্ব মেধা, বিবেক ও আমাল এই প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে কার্যকর নয়। শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা যদি চান তবেই কোন বান্দা তার মানযিলে মাকছুদে পৌঁছাতে পারে। আর এটার জন্য প্রয়োজন সঠিক পথ তথা সীরাতে মুস্তাকিমে চলার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে বিশেষ তাওফীক কামনা করা। উপরে বর্ণিত প্রতিবন্ধকতা থেকে আশ্রয় বা পানাহ চাওয়া। আশ্রয় চাওয়ার দ্বারা যেমন প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়, অন্যদিকে আল্লাহর কাছে নিজের অক্ষমতাও প্রকাশ পায়। মানুষ কারো কাছে তখন আশ্রয় চায় যখন সে একথা জানে যে, আমি বড় অক্ষম, নির্দিষ্ট কাজটি করতে আমি অপরগ। আর যার কাছে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে তিনি বড় সক্ষম। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এই অপরগতা, অক্ষমতা স্বীকার করে তাঁর কাছে মানুষ, জ্বিন, নাফছ শয়তানসহ সর্বপ্রকার অনিষ্টকর জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার গুরুত্ব ও নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। খোদ আম্বিয়া (আ.) গণকেও এর তাকীদ করেছেন। কুরআনের মধ্যে একাধিক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা এই আশ্রয় চাওয়ার গুরুত্ব ও তার লব্ধ উপকারিতা উল্লেখ করে আয়াত নায়িল করেছেন। এমনি ভাবে সার্বিক বিবেচনায় প্রত্যেকটি বান্দার জন্য আবশ্যক হল আশ্রয় চাওয়া সম্পর্কে একটি সম্মক ধারণা রাখা ও তার নিয়ম কানুন জানা আর গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার উপর আমাল করা।
আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন, فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ অতঃপর আপনি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
কুরআন ও হাদীছের উদ্ধৃতি অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার কয়েকটি পদ্ধতি অধিক প্রসিদ্ধ।
(১) أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
বিতাড়িত শয়তান হতে আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
(২) أَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
আমি বিতাড়িত শয়তান হতে মহান শ্রোতা ও মহা জ্ঞানী আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
(৩) أَعُوْذُبِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ العَلِيْمُ
আমি বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, নিশ্চয় তিনিই মহান শ্রোতা ও মহা জ্ঞানী।
(৪) نَعُوْذُ بِاللهِ
আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
(৫) مَعَاذَ اللهِ
আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আশ্রয় চাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার আদেশ, গুরুত্ব ও তার নিয়ম কানুনঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ —النحل 98
অতএব আপনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করেন। (সুরা নাহল, আয়াত নং ৯৮)
বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা।
এই আয়াতে যদিও কুরআন তিলাওয়াত করার পূর্বে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে কিন্তু অন্যান্য আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়ার হুকুম আম (সাধারণ)।
আল ইযতিয়াযাহঃ আশ্রয় চাওয়া, আশ্রয় নেওয়া, আত্মরক্ষা করা, পানাহ চাওয়া, (আল মু’জামুল ওয়াফী)
‘‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশশাইতানির রাজীম’’ বলা। (আল মু’জামুর রায়িদ) এখানে ইযতিয়াযা’র দ্বারা উদ্দেশ্য হল নিজের অক্ষমতায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া।
শয়তান থেকে আশ্রয়ঃ আরবী ভাষায় মানুষ, জ্বিন, চতুষ্পদ জন্তুসহ প্রত্যেকটি বিদ্রোহী ও উদ্ধত জিনিসকে শয়তান বলে। যেমন, হযরত আবু জাফর (রহ.) বলেন,
كُلُّ مُتَمَرِّدٍ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ وَالدَّوَابِّ وَكُلّ شَيٍّء — تفسير الطبرى
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শয়তান বলতে আমরা অবাধ্য জ্বিনকেই বুঝে থাকি।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমের মধ্যে মানুষকে প্রত্যেক প্রকার অবাধ্য মানব ও জ্বিনসহ সকল প্রকার অনিষ্ট ও চক্রান্ত থেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা ও তার ফায়দা বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেকেরই আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক। আম্বিয়া (আ.) ও আউলিয়া (র.) এই পথ অনুসরণ করেছেন। কুরআন শরীফের মধ্যে নবী ও রসূলগণের আশ্রয় চাওয়া ও তার প্রাপ্ত লাভের কথা এসেছে। এখানে কয়েকটি শিক্ষার জন্য উল্লেখ করা হল। আল্লাহ আমাদের বোঝার ও আমাল করার তাওফীক দান করেন। আমীন।
(এক) হযরত নুহ (আ.) এর ঘটনা। স্বীয় সম্প্রদায়ের অস্বীকার আর অবাধ্যতায় বাধ্য হয়ে হযরত নুহ (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের বিরুদ্ধে দোয়া করলেন। সমস্ত যমীন মহাপ্লাবনে প্লাবিত হয়ে গেল। আশ্রয়ের কোন জায়গা থাকলো না। নুহ (আ.) এর পুত্র কিনআন ছিল কাফির যা তিনি জানতেন না। সে কাফিরদের সাথেই ছিল। নুহ (আ.) তাকে আহবান করলেন হে পুত্র- তুমি আমাদের সাথে (এই নৌকায়) আরোহণ করো; কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। নুহ (আ.) আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন, হে আল্লাহ আমার ছেলেতো আমার পরিবারভুক্ত। আর আপনার ওয়াদা হল আপনি আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংসে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন,
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ
হে নুহ! নিশ্চয়ই সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার। সুতরাং আমার কাছে এমন আবেদন করবেন না, যার খবর আপনি জানেন না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের দলভুক্ত হবেন না। (সূরা হুদ, আয়াত ৪৬)
আম্বিয়াদের (আ.) বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহর হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে বিনা চিন্তায় বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতেন। হযরত নুহ (আ.) ছেলের বিষয়ে না জানার কারণে যে দোয়া করেছিলেন তার জন্য অনুতপ্ত হলেন এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাইলেন।
তিনি বলেন رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْئَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ — هُود: 47
হে আমার প্রতিপালক আমার যা জানা নেই এমন কোন বিষয়ে দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থণা করছি।
ফায়দাঃ হযরত নুহ (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন আর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দু’টি বিশেষ সম্মান দান করেছেন। (১) ছালাম, (২) বারাকাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, يَا نُوحُ اهْبِطْ بِسَلامٍ مِنَّا وَبَرَكاتٍ عَلَيْكَ وَعَلَى أُمَمٍ مِمَّنْ مَعَكَ — هُود48
হে নুহ! আপনি (নৌকা থেকে ভূপৃষ্ঠে) অবতরণ করেন আমার পক্ষ হতে শান্তি ও নিরাপত্তা সহকারে আর আপনার ও আপনার সাথীদের উপর বারাকাত নিয়ে। (সূরা হুদ, আয়াত নং ৪৮)
(দুই) হযরত ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যখন ঐ মহিলা (যুলেখা) তাঁকে বিভিন্নভাবে ফুসলাতে থাকে শেষ পর্যন্ত হাতের নাগালে পেয়ে যায় তখন সে হযরত ইউসুফ (আ.) কে তার খারাপ বাসনার কথা প্রকাশ করে। ইউসুফ (আ.) ঐ সময় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। কুরআনের ভাষায়, قَالَ: مَعاذَ اللَّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوايَ — يُوسُف23
অর্থাৎ তিনি বললেন, আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। নিশ্চয়ই তিনি (তোমার স্বামী) আমাকে লালন পালন করেছেন, অতি উত্তম আশ্রয় দান করেছেন। ইউসুফ (আ.) এমন বিপদে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন আর আল্লাহ তায়ালা তাকে বিশেষ দুটি সম্মান সুচক উপহার দান করেছেন। (১) মন্দ বিষয় থেকে হিফাজত (২) নির্লজ্জ বিষয় থেকে হিফাজত। কুরআনের ভাষায়, لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشاءَ যাতে আমি তার থেকে মন্দ বিষয় ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই।
(তিন) হযরত ইউসুফ (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে আরো আশ্রয় চেয়েছেন। যখন তার ভাইয়েরা তাকে বলল, আপনি তার পরিবর্তে আমাদের একজনকে আটকে রাখেন। সংক্ষিপ্ত ঘটনা হল, হযরত ইউছুফ (আ.) ভাইদের দ্বারা কূপে নিক্ষিপ্ত হলেন। একদল বণিক দ্বারা উদ্ধার পেয়ে মিশরে এসে পৌঁছালেন। আযীযে মিশরের তত্বাবধানে থাকতে লাগলেন। মিথ্যা তোহমাতে কারাগারে প্রেরিত হলেন। এক পর্যায়ে মিশরের মন্ত্রী হলেন। এদিকে ইউছুফ (আ.) এর স্বদেশে দূর্ভিক্ষ দেখা দিল। ইউছুফ (আ.) এর ভাইয়েরা খাদ্য নিতে উপস্থিত স্বয়ং তাঁর সামনে। ভাইয়েরা না চিনলোও তিনি তাদেরকে চিনে ফেললেন। এই ভাইদের সাথে ছিল এক মায়ের গর্ভে ধারণ করা তাঁরই ভাই বিন ইয়ামিন। ইউছুফ (আ.) পরিকল্পনা করলেন কিভাবে তাঁর এই ভাইকে তাঁর কাছে রেখে দেওয়া যায়। সেই হিসাবে বিন য়ামীনকে যে খাদ্য দেওয়া হয়েছিল তার সাথে একটি পাত্র ভাইদের অজান্তে রেখে দেওয়া হয়েছিল। দোষী হিসাবে তাকে আটকে দেওয়া হল। তাঁর ভাইকে যখন আটকে দেওয়া হল তখন তাঁর ভাইয়েরা বলল বিন ইয়ামীনকে ছেড়ে দিন আর আমাদের একজনকে আটকে রাখেন।
কুরআনের ভাষায় فَخُذْ أَحَدَنا مَكانَهُ অর্থাৎ (হে আযীয) আপনি আমাদের একজনকে তার বদলে রেখে দেন। (সূরা ইউসুফঃ৭৮) তখন ইউসূফ (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাইলেন। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমরা যার কাছে মাল পেয়েছি তাকেই শুধু আটকে রাখতে চাই। কুরআনের ভাষায়, مَعاذَ اللَّهِ أَنْ نَأْخُذَ إِلَّا مَنْ وَجَدْنا مَتاعَنا عِنْدَهُ — يُوسُفَ: 79
অর্থাৎ যার কাছে আমরা আমাদের মাল পেয়েছি তাকে ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। এই আশ্রয় চাওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে দুটি পুরষ্কার দান করলেন, (১) তার পিতাকে সিংহাসনে আরোহণ, (২) তার সকল ভাইকে তার সামনে বিনয় ও সম্মানসুচক মস্তক অবনতকরণ। কুরআনের ভাষায়, وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّداً، —يُوسُفَ: 100 অর্থাৎ তিনি পিতা মাতাকে সিংহাসনে বসালেন এবং তারা সবাই তার সামনে ছিজদাবনত হল।
(চতুর্থ) আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়া সম্পর্কে হযরত মুছা (আ.)-
সুদ্দী (র.) বর্ণনা করেন, বনী ইসরাইলের এক যুবক তার ধনী চাচার বিশাল ধন ভাণ্ডার হস্তগত ও তার মেয়েকে বিবাহ করতে ব্যর্থ হয়ে একটি বিরাণ এলাকায় ডেকে নিয়ে হত্যা করে। বনী ইছরাইলের কিছু নেক লোক ছিল যারা দুষ্টদের থেকে পৃথক হয়ে একটি দুর্গে বাস করতেন। সকালে তারা দুর্গের দরজা খুলতেন আর সন্ধায় বন্ধ করতেন। ঘাতক এই যুবক তার চাচার মৃতদেহকে নেক লোকদের দুর্গের সামনে ফেলে রেখে তাদেরকে এই হত্যার জন্য দায়ী করে। নেককার ঐ লোকগুলো এই ব্যাপারে হযরত মুছা (আ.) এর কাছে অভিযোগ করেন। মুছা (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে বললে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে একটি গরু যবেহ করার আদেশ দিলেন। কোথায় হত্যাকারীর পরিচয় আর কোথায় গরু যবেহ। এটা কোন উপহাস নয় তো?
তাঁর গোত্রীয় লোকদের (ঐ দুর্গবাসীদের) যখন তিনি গরু যবেহ করার আদেশ দিলেন তখন তারা বললেন, أَتَتَّخِذُنا هُزُواً তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছো? তদুত্তরে হযরত মুছা (আ.) বললেন, أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجاهِلِينَ আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি মুর্খদের দলভুক্ত হওয়া থেকে। (সূরা বাকারা ৬৭) এই আশ্রয় চাওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে দুটি বিশেষ পুরষ্কার দান করলেন, (১) অপবাদ অপনোদন, (২) নিহতের উজ্জীবন। কুরআনের ভাষায়,
فَقُلْنا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِها كَذلِكَ يُحْيِ اللَّهُ الْمَوْتى وَيُرِيكُمْ آياتِهِ — الْبَقَرَةِ: 73
অর্থাৎ অতঃপর আমি বললাম গরুর একটা অংশ দ্বারা মৃতকে আঘাত করো। এভাবে আল্লাহ তায়ালা মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন।
(পঞ্চম) যখন মুছা (আ.)কে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা হত্যা করার ভয় দেখালেন তিনি বললেন, তোমরা যাতে আমাকে হত্যা না করো এজন্য আমি আমার ও তোমাদের রবের শরণাপন্ন হচ্ছি। (সূরা দুখান ২০) অন্যত্র তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চেয়ে বলছেন, আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় চাচ্ছি প্রত্যেক অহংকারী হতে যারা হিসাবের দিনকে বিশ্বাস করে না। (সূরা গাফির, ২৭) এই আশ্রয় চাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে তিনটি জিনিস দান করেছেন, (১) আল্লাহ তায়ালা তার উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করলেন, (২) তার শত্রুদেরকে ধ্বংস করলেন, (৩) শত্রুদের ভূমিকে তার মালিকানায় দিয়ে দিলেন।
(ষষ্ঠ) হযরত মারয়াম (রা.) সংশ্লিষ্ট। ইমরানের স্ত্রী যখন বললেন, আমার গর্ভে যা রয়েছে তা আমি আপনার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে আপনি তাকে কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত। অতঃপর যখন তাকে (মারয়ামকে) প্রসব করলেন, বললেন হে আমার পালনকর্তা ! আমি একে কন্যা প্রসব করেছি। বস্তুতঃ সে কী প্রসব করেছে আল্লাহ তা ভালই জানেন। সেই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম মারয়াম। (সূরা আল ইমরান, আয়াত নং ৩৫,৩৬) এরপর হযরত মারয়াম (রা.) এর আম্মা তার জন্য এবং তার সন্তান সন্তুতির জন্য বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাইলেন। কুরআনের ভাষায়, وَإِنِّي أُعِيذُها بِكَ وَذُرِّيَّتَها مِنَ الشَّيْطانِ الرَّجِيمِ — آلِ عِمْرَانَ: 36
আর আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। আল্লাহ তায়ালা তাকে মহা পুরষ্কৃত করলেন, (১) মারয়াম (রা.)কে কবুল করলেন, (২) তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন। কুরআনের ভাষায়,
فَتَقَبَّلَها رَبُّها بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَها نَباتاً حَسَناً —آلِ عِمْرَانَ: 37 অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন- অত্যন্ত সুন্দর প্রবৃদ্ধি।
(সপ্তম) হযরত মারয়াম (রা.) যখন নিভৃতে হযরত জীবরীল (আ.) কে মানুষের আকৃতিতে দেখলেন তখন বললেন,
إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمنِ مِنْكَ إِنْ كُنْتَ تَقِيًّا আমি আপনার থেকে মহান দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি যদি আপনি আল্লাহভীরু হয়ে থাকেন। (সূরা মারয়াম ১৮) আল্লাহ তায়া তাকে দু’টি নিআমাত দান করলেন, (১) পিতা ছাড়াই সন্তান, (২) স্বয়ং ঐ সদ্য ভুমিষ্ট সন্তানের মুখে তার মায়ের সততা তথা নিষ্কলুষতা। কুরআনের ভাষায়, قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا
তিনি (ছোট শিশু ঈছা) বললেন, আমিতো আল্লাহর বান্দা তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও আমাকে নবী করেছেন।
(অষ্টম) আমাদের নবী সায়্যিদুল মুরছালিন মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স.) কে আল্লাহ তায়ালা আশ্রয় প্রার্থনার জন্যে অনেক তাকীদ দিয়েছেন। তাঁর (স.) মাধ্যমে আমাদেরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এই সমস্ত আয়াত থেকে আমরা বিতাড়িত শয়তান, শত্রু ও অনিষ্টকর জিনিস থেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি ও সে বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারি। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزاتِ الشَّياطِينِ وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ —الْمُؤْمِنُونَ: 97، 98 অর্থাৎ “আর আপনি বলুন, হে আমার পালনকর্তা আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এবং হে আমার পালনকর্তা আমার নিকট তাদের উপস্থিতি থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন হে মুহাম্মাদ (স.) আপনি বলুন,
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ অর্থাৎ আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের রবের কাছে।
আল্লাহ তায়ালা হুজুরে আকরাম (স.) কে শিক্ষা দিচ্ছেন,
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ অর্থাৎ আপনি বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের রবের কাছে।
আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষাঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجاهِلِينَ وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ —الْأَعْرَاف:199-200
আর ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোলেন, সৎ কাজের আদেশ দেন আর জাহিলদের থেকে দূরে থাকেন। আর যদি শয়তানের প্ররোচনা আপনাকে প্ররোচিত করে তাহলে আল্লাহর শরণাপন্ন হন। তিনিই শ্রবনকারী মহা জ্ঞানী।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35) وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (36) فصلت
ভাল ও মন্দ সমান নয়। উত্তরে তাই বলেন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এই চরিত্র তারাই লাভ করে যারা সবর করে এবং এই চরিত্রের অধিকারি তারাই হয় যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান। যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কু মন্ত্রণা অনুভব করেন তবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। (সূরা হা-মীম ছিজদা, আয়াত নং ৩৪,৩৫,৩৬)
এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় আম্বিয়া (আ.)গণ সদা সর্বদা মানুষ ও জ্বিন শয়তানসহ সর্ব প্রকার অনিষ্টকর বস্তু থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন আর আল্লাহ তায়ালাও তার উত্তম পুরষ্কার দিয়েছেন। আমাদেরও উচিত সকল সংকটে তাঁদের (আ.) পথ অনুসরন করে নিজের অক্ষমতাকে প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাওয়া।
চলবে ইনশাআল্লাহ। “পর্ব ২ পড়ার জন্য অনুরোধ রইল।