আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا— البقرة 97
আর এই ঘরের হজ্জ করা হল মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য : যে লোকের সামর্থ রয়েছে এখানে পৌঁছার। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ৯৭)
ইছলামের পাঁচটি বিশেষ স্তম্বের মধ্যে হজ্জ একটি। যার উপর হজ্জ ফরয আর সে হজ্জ না করে ইনতিকাল করে তার সম্পর্কে খুবই কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়েছেন দয়ার নবী সায়্যিদুল মুরছালিন হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স.)। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পযন্ত পৌছার মত সম্বল ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হ্জ্জ না করে তবে সে ইয়াহুদি হয়ে মারা যাক আর নাসারা হয়ে মারা যাক তাতে (আল্লাহ তায়ালার) কোন ভাবনা নেই। (তিরমিযী, হাদীছ নং ৮১২) কাজেই ইছলামের এই মৌলিক বিষয়টি যার উপর ফরজ হয়ে গেছে অনতিবিলম্বে তার আদায় করা আবশ্যক। প্রত্যেক মুছলমান যার হজ্জের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে যাওয়ার, ফিরে আসার ও সেখানে অবস্থানকালীন নিজের খরচ ও পরিবারের ভরণপোষণের মত সামর্থ আছে তার উপর হজ্জ ফরজ। ফরজ এই ইবাদাতটি আদায় করার জন্য হজ্জের নিয়াত করার সাথে সাথে এতদসংক্রান্ত ইলম অর্জন করাও দরকার।
কখন কী জানতে হবে ও করতে হবে?
(এক) কোন মাধ্যমে হজ্জে যাবেনঃ আমাদের দেশে সাধারণত দুই পদ্ধতিতে লোকেরা হজ্জে যায়। (১) সরকারীভাবে, (২) বেসরকারীভাবে,
(১) সরকারীভাবে যদি কেউ যেতে চায় তবে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী তাকে নির্দিষ্ট ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয়। এরপর পরবর্তী করণীয় পর্যায়ক্রমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তদানুযায়ী অগ্রসর হতে হয়। এই পদ্ধতিতে ঠকার ভয় থাকে না। তবে সুদক্ষ পরিচালক না থাকলে মক্কা এবং মাদীনাতে সকল কাজ সুচারু রূপে করাটা বড়ই কঠিন হয়ে যায়। যদিও ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান দেখাটা হজ্জের সাথে সম্পর্কিত কোন বিষয় নয়, তারপরও যেহেতু ইচ্ছা করলেই সেখানে যাওয়া যায় না; হয়ত অনেকের জন্য একবারের বেশি যাওয়াও সম্ভব হয় না এই জন্য সম্ভবত প্রতিটি হাজী এই সমস্থ জায়গাগুলো পরিদর্শনে যেতে চান এবং গিয়েও থাকেন। এই সমস্ত ক্ষেত্রে এই ব্যস্থাপনায় একটু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় যেতে চাইলে এমন কিছু সাথী একত্রিত হওয়া দরকার যাদের মধ্যে কেউ হজ্জ বিষয়ে অনেক পারদর্শী। এখানে খরচের বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার। বেসরকারীভাবে গেলে যে খরচ হবে এখানে তুলনামূলকভাবে খরচ একটু বেশি। খাদ্য খানাটা ইচ্ছামত তবে রান্না নিজেদের দায়িত্বে। বড় সুবিধা হল এখানে ঠকার ভয় নেই।
(২) বেসরকারীভাবে যেতে চাইলে কোন এজেন্সির মাধ্যমে যেতে হবে। দেশে বৈধ অবৈধ অনেক এজেন্সি আছে। সে ক্ষেত্রে এজেন্সি নির্বাচনে অনেকটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এখানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। হজ্জের বিভিন্ন কাজগুলো এজেন্সির লোকেরা সাধারণত দেখভাল করে থাকেন। বিভিন্ন স্থানগুলো তারা ঘুরিয়েও দেখিয়ে থাকেন। রান্নার বিষয়েও প্রায় কোন চিন্তা থাকে না। তবে এখানে প্রতারণার সম্মুখীন হতে হয় খুব বেশি। চাহিদা অনুযায়ী যদি মাক্কা বা মদীনায় সব কিছু পেতে চান তাহলে কিন্তু আগে থেকেই ধৈর্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে হবে। কারণ চুক্তির বিপরীত অনেক জিনিস সেখানে দেখতে পাবেন। কুরবানীর ব্যাপারেও অনেক বেশি হুশিয়ার থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কুরবানী একেবারেই দেওয়া হয় না। সকল এজেন্সি এমন তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেন জানি এমন হয়ে যায়। যদি কেউ বেসরকারীভাবে যেতে চান তবে প্রথমেই এজেন্সি সম্পর্কে খোজ খবর নিতে হবে, তাদের অতীত মোয়ামালা কেমন সে বিষয়টি যতদুর সম্ভব তাহকীক করতে হবে। কুরবানী নিজের যিম্মায় রেখে দিতে হবে। সবরের নিয়াতে যেতে হবে। ক্ষমা করার মনমানসিকতা রাখতে হবে। হযরত রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এই ঘরের (বাইতুল্লাহর) হজ্জ আদায় করল, অশ্লীলতায় জড়িত হল না, আল্লাহর কোন অবাধ্যতা করল না সে মায়ের পেট হতে সদ্য প্রসূত শিশুর ন্যায় (হজ্জ থেকে) ফিরে আসল (বুখারী, হাদীছ নং ১৮২০) এই হাদীছের দিকে খুব মনোযোগী হতে হবে। এমন কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন যেখানে আপনি উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। ঘটে যেতে পারে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনাও। সেক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে তাদের উদ্দেশ্য যে লাভ অর্জন করা সেটা তারা পেয়ে গেছে কিন্তু আমার যে উদ্দেশ্য ছিল সদ্য প্রসূত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসা সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। এজেন্সির লোকেরাতো ব্যবসায়িক স্বার্থে লাভের দিকে লক্ষ্য দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে হাজীগণ মাকবুল হজ্জ ও সওয়াবের দিকে তাকিয়ে সবরের দিকে লক্ষ রেখে যদি কাজ সমাধা করার চেষ্টা করেন তাহলে ইনশাআল্লাহ অসুবিধা হবে না। এজেন্সির লোকেরা যে সুবিধাসমূহের কথা বলবেন ধরে নিতে হবে আমি তার অর্ধেক পাবো। যদি তারা বলেন বাসা হবে ৭০০ মিটার দূরে ধরে নিতে হবে বাসা হবে ১৫০০ মিটার দূরে। এমন একটা মনমানসিকতা যদি আগে থেকেই তৈরী করে নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে বাসা ১০০০ মিটার দূরে হলেও রাগ হবে না। মনে হবে ভেবেছিলাম দেঢ় কিলোমিটার দূরে বাসা হবে এখনতো দেখি এক কিলোমিটার দূরে বাসা। এমনিভাবে প্রতিটি বিষয়।
এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, অনেক হাজী সাহেব এজেন্সির লোকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেন সেটাও কাঙ্খিত নয়। টাকা কম, চাহিদা বেশি এটাতো সুস্থ বুদ্ধির পরিচায়ক হতে পারে না। অনেক লোকের একত্রে রান্না। সময়মত খানার সরবরাহ নাও হতে পারে। ঝাল, নুন একটু কম বেশি হতেও পারে। সেক্ষেত্রে অনেক হাজীদের থেকে যে আচরণ দেখা যায় সেটা বড় লজ্জাজনক। বিমান দেরি হল কেন, সিডিউল পরিবর্তন হল কেন ইত্যাদি বিষয় নিয়েও বড় ন্যক্কার জনক ঘটনা ঘটে থাকে। আমাদের গাড়ির আগে অমুক এজেন্সির গাড়ি ক্রস করলো কেন, তাদের গাড়ির রং আমাদের চেয়ে ভালো কেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে সুবিধা অসুবিধার মধ্য দিয়েই হজ্জ করতে হবে। ক্ষমা ও সবরের কোন বিকল্প নেই। এগুলোর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দু’টি দোয়া করতে হবে, (ক) হে আল্লাহ সহজ করেন, (খ) ইয়া আল্লাহ কবুল করেন। মূলত এই দু’টি দোয়া ইহরাম বাধার সময় পড়তে হয়।
এবার বড়দের সাথে পরামর্শ করে কোন এজেন্সির মাধ্যমে হজ্জে যাবেন সেটা ঠিক করতে হবে। সরকারীভাবে গেলে টাকা একসাথেই পরিশোধ করতে হয় আর বেসরকারীভাবে গেলে ধাপে ধাপে দিলেও চলে। এজেন্সি ভিন্নতায় এই নিয়মও ভিন্ন হয়ে থাকে। এমন অনেক এজন্সিও আছে যারা কিছু টাকা অগ্রিম নিয়েছে আর বাকি টাকা হজ্জ থেকে ফেরার পরে নিয়েছে।
(দুই) টাকা সংগ্রহ : যেহেতু হারাম টাকায় ইবাদাত নষ্ট, এই জন্য পুরাপুরি বৈধ টাকায় হজ্জ করতে হবে। যদি বৈধ টাকা না থাকে আর প্রচুর পরিমাণে অবৈধ টাকা থাকে তবেতো তার উপর হজ্জই ফরজ নয়। কারণ অবৈধ টাকার মালিকতো তিনি নন। যেমন সুদ ঘুষের টাকার মালিক তিনি নন। এক্ষেত্রে অনেককে দেখা যায় বৈধ টাকা দিয়ে হজ্জ করার জন্য জমিও বিক্রি করে। গ্রামে এমনটি ঘটে বেশি। যাই হোক বৈধ টাকা যোগাড় করে হজ্জে যেতে হবে।
(তিন) হজ্জের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম শেখাঃ হজ্জসহ প্রত্যেকটি ইবাদাতের জন্য প্রয়োজন তদসংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক ইলম। আপনি ইতিমধ্যে হজ্জের টাকা জমা দিয়েছেন। এখন আপনাকে কোন মুহাক্কিক আলেমের নিকট বেশি করে যাতায়াত করতে হবে। তাঁর থেকে আনুষাঙ্গিক ইলম শিখে নিতে হবে। শেখার মধ্যে বেশি গুরুত্ব দিবেন হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত সম্পর্কিত ইলমকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় হজ্জের ফরজ ওয়াজিব না শিখে বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত লম্বা লম্বা দোয়া মুখস্ত করতে। ফলে এই দোয়াগুলোতো মুখস্ত হলই না সাথে সাথে প্রয়োজনীয় দোয়া থেকে সে বঞ্চিত হল। সাত তাওয়াফের কোন পাকে কী পড়তে হবে এই বিষয়ে যে দোয়াগুলো পাওয়া যায় এগুলোর অর্থ বড় ভালো কিন্তু এগুলো হাদীছে বর্ণিত দোয়া নয়। এই জন্য দুই তিন পৃষ্ঠার এই দোয়ার দিকে মনোযোগী না হয়ে আলেমদের নিকট থেকে আবশ্যকীয় ইলমগুলো শেখার প্রতি মনোযোগী হবেন বেশি। আমাদের সমাজে অনেককে দেখা যায় তারা হজ্জ সম্পর্কে এমন কঠিন ধারণা দেন বা ব্যাখ্যা দেন যা শুনলে মানুষ হিম্মাত হারিয়ে ফেলে। এগুলো বড় দুঃখজনক। এমন ধরণের উদ্যোগ থেকে সবাইকে বিরত থাকা উচিত। বরং আমাদের উচিত হল মানুষকে উৎসাহ দেওয়া, সাহস যোগানো। এই সমস্ত সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একটা সহজ উপায় হল মুহাক্কিক আলেমদের সাথে থেকে হজ্জ করা। হজ্জের আগেও তার থেকে পৃথক না থাকা হজ্জে যেয়েও মার্কেটিং বা অন্য কোন শোগলে জড়িয়ে পড়ে আলেম থেকে পৃথক না হওয়া। মনে রাখতে হবে, বাজার কেনাকাটা বা বিভিন্ন জিনিস দেখা বা ভিডিও করা যেন আমাদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত না হয়। কেনাকাটা দেশে এসেও সমাধান করা যাবে। না হয় মান একটু খারাপ হল। সেটাতে ইবাদাতের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু হজ্জে ত্রুটি এসে গেলে দেশে এসে তা সংশোধন করা যাবে না। পরে যদি আবারও হজ্জ করেন তবে সেটাতো হবে নফল হজ্জ। আপনার ফরজ হজ্জতো ত্রুটিপূণই থেকে গেল। দ্বিতীয়বার বা একাধিকবার হজ্জ করেও তার প্রতিবিধান করবেন কি করে? এই জন্য আলেমদের সাথে থেকে সবটা সমাধা করার চেষ্ট করবেন। কোথায় কী করতে হবে তার কাছ থেকে ঠিক করে নিতে পারবেন। (চলবে ইনশাআল্লাহ, পর্ব ২ পড়ার জন্য অনুরোধ থাকলো)