আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ মদীনায় আগমন করলেন। আমি তাঁর থেকে পূর্বে যে নিবিড় ভালোবাসা পেয়েছি তা আর পেলাম না। মানুষেরা ইফকের ঘটনা বলাবলি করছিল অথচ আমি এই সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। একমাস পর্যন্ত আমি খুব কষ্ট পেলাম। তাঁর দ্বারা এর পূর্বে আমি কখনও এমন কষ্ট পাইনি।
(একদিন) রসূলুল্লাহ আমার কাছে এসে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। এরপর ফিরে গেলেন। আমি আরো বেদনাহত হলাম। আমি ব্যাপরটি তখনও উপলব্ধি করতে পারি নি। অবশেষে বিষয়টি জানতে চেষ্টা করলাম। একদিন আমি উম্মে মিসতাহের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম মাঠের দিকে প্রাকৃতিক জরুরত সারতে। আমরা আমাদের ঘরের পাশেই বিচরণ করতাম। আমি এবং উম্মে মিসতাহ রাতে ছাড়া বের হতাম না। উম্মে মিসতাহ ছিল, আবু রিহাম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের মেয়ে আর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর খালা। তার ছেলে হল মিছতাহ ইবনে উছাছা ইবনে উব্বাদ ইবনে মুত্তালিব।
প্রাকৃতিক হাজত পূর্ণ করার পর আমি এবং উম্মে মিসতাহ আগমন করছিলাম। কিন্তু দ্রুত হাটার কারণে উম্মে মিসতাহ হোচট খেয়ে পড়ে যান। তখন উম্মে মিসতাহ তার ছেলেকে বদদোয়া দিলেন। আমি বললাম, আপনি তাকে বদদোয়া দিচ্ছেন অথচ তিনি বদরী সাহাবী। উম্মে মিসতাহ বললেন, আপনি কি জানেন, সে আপনার সম্পর্কে কী বলে? আমি বললাম, সে কী বলে? অতঃপর তিনি ইফকের ঘটনাটি আমাকে বললেন। এবং বললেন, নিশ্চয়ই আপনি মুমিনাহ এবং অনবগতশীলদের মধ্যে। এরপর আমার বেদনা আরো বেড়ে গেল। এরপর আমি বাড়িতে ফিরলাম। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে আসলেন। আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, আমাকে কি একটু আমার পিতা মাতার কাছে যেতে দিবেন? আমার ইচ্ছা ছিল তাঁদের কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। রসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি আমার পিতা মাতার কাছে আসলাম। আমি আমার আম্মাকে বললাম, মা! লোকেরা এসব কী বলে? আম্মা আমাকে সান্তনা দিলেন। আমিও আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করলাম।
আমি ঐ রাত সকাল পর্যন্ত কেঁদে কাঁটিয়েছি। আমার চোখের পানি সমান্য সময়ের জন্যও বন্ধ হয়নি। ইত্যবসরে আমার আব্বা আমার কাছে আসলেন। আমি তখনও কাঁদছিলাম। আমার আব্বা আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কাঁদে কেন? আম্মাজান বললেন, আপনি কি জানেন না, তাঁর সম্পর্কে কী বলা হচ্ছে? আমি শুধু কাঁদতেই ছিলাম।
আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত উছামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) কে ডাকলেন। তখনও এই বিষয়ে ওহী নাযিল হয়নি। তিনি ওহীর অপেক্ষায় ছিলেন। আর রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারকে ত্যাগ করবেন কিনা সে বিষয়ে এই দুইজনের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন। হযরত উছামা (রাঃ) বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! সে তো আপনার পরিবার। আমরা তাঁকে ভালোই জানি। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, আল্লাহ আপনাকে সংকীর্ণ করবেন না। তিনি ব্যতীত আরো মহিলা আছে। আপনি বাদিকে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনাকে তাঁর ব্যাপারে সত্যায়ন করবেন। এরপর রসূলুল্লাহ বারিরাহকে (বাদি) ডাকলেন। তিনি তাকে বললেন, তোমার এই বেদনাদায়ক বিষয় সম্পর্কে অভিমত কী? তিনি বললেন, ঐ সত্বার ক্বছম যিনি আপনাকে সত্য নবী করে প্রেরণ করেছেন, আমি তার বিষয়ে আপত্তিকর কোনো কিছু দেখিনি, শুধু এতটুকু যে, সে অল্প বয়স্কা একটি বালিকা, রুটির খামির করতে কতে ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর গৃহপালিত পশু এসে খেয়ে ফেলেÑ(এমন সরলমনা ছোট্ট একটি মেয়ের ব্যাপারে কী ধারণা করা যেতে পারে?)
আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, এরপর হযরত রসূলুল্লাহ মিম্বারে দাঁড়ালেন এবং খোতবা দিলেন। তিনি বললেন, হে মুসলমানদের জামায়াত! তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে আমার ওজর আপত্তি শুনবে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে যে আমাকে আমার পরিবারের ব্যাপারে কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর ক্বছম, আমি আমার পরিবারকে ভালোই জানি। আমি অনেক লোকের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। তারা ভালো জানে। অতঃপর হযরত সায়ীদ ইবনে মুয়াজ (যিনি বনু আশহালের ভাই) দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আমি, ইয়া রসুলাল্লাহ! কৈফিয়াত তলব করব। যদি ঐ ব্যক্তি ( যে ব্যক্তি অপবাদ দিয়ে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে) আউছ গোত্রের হয় তবে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব। আর যদি সে খাজরাজ গোত্রের হয় তবে তাদের ব্যাপারে আপনি যা বলবেন আমরা তাই করব। এরপর হযরত সায়ীদ ইবনে উবাদা দণ্ডয়মান হলেন। তিনি ছিলেন খাজরাজ গোত্রের বড় নেককার মানুষ কিন্তু স্বজাতীর টান তাকে ক্রোধোদ্দীপ্ত করে তুলল।
তিনি সা’আদ ইবনে মুআযকে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহর ক্বছম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। এরপর উছাইদ ইবনে হুজাইর দাঁড়ালেন। তিনি সা’আদ ইবনে মুআযের চাচা। অতঃপর সা’আদ ইবনে উবাদা বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহর ক্বছম, আমরা তাকে হত্যা করব। তুমি এক জন মুনাফিক অপর মুনাফিকের পক্ষ হয়ে ঝগড়া করছ। এভাবে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আউছ ও খাজরাজ হত্যাযজ্ঞের জন্য পরস্পর মুখোমুখি হল। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) তখনও মেম্বরে বসে আছেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে প্রশমিত করলেন। তারা চুপ হল। আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, আমি সারা দিন আর সারা রাত কাঁদলাম। আমার চোখের পানি বন্ধ হচ্ছিল না। ঘুমও দূর হয়ে গিয়েছিল। সকালে আমার পিতা আমার কাছে আসলেন। আমি দুই দিন একরাত শুধু কেঁদেই কাটিয়েছি। আমি ধারণা করছিলাম কান্নার কারণে আমার কলিজা বিদীর্ণ হয়ে যাবে। আমার পিতা মাতা আমার নিকট বসে আছেন এমন সময় আনসারী একজন মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইল। আমি অনুমতি দিলাম। সে আমার পাশে বসে কাঁদছিল। আমরা সবাই এমন অবস্থায় ছিলাম হঠাৎ করে রসূলুল্লাহ (সা.) প্রবেশ করলেন এবং আমাদেরকে ছালাম দিলেন। এরপর তিনি বসলেন।
আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, অথচ আমার ব্যাপারে এই ক্লেদপূর্ণ কথা চলাকালিন সময়ের মধ্যে তিনি কখনও আমার পাশে বসেননি। এক মাসের মত অতিবাহিত হয়ে গেল, এর মধ্যে এই সংক্রান্ত কোন ওহীও নাযিল হয়নি। এরপর তিনি আমার পাশে বসে তাশাহ্হুদ পড়লেন এবং বললেন, আম্মা বাদ, হে আয়িশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এমন এমন কথা পৌঁছেছে। যদি তুমি এই দোষ হতে মুক্ত হও তবে অচিরেই আল্লাহ তোমার দোষমুক্তির ঘোষণা দিবেন। আর যদি তুমি দোষি হও তবে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও ও তাঁর কাছে ফিরে এসো। কেননা বান্দা যখন গোনাহের কথা স্বীকার করে এরপর তওবা করে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) যখন তার কথা শেষ করলেন তখন আমার চোখের পানি নিঃশেষ হয়ে গেল। এমনকি এক ফোঁটাও আর অনুভব করলাম না। আমি আমার আব্বাকে বললাম, আব্বা! আমার পক্ষ থেকে আপনি রসূলুল্লাহ (সা.) কে উত্তর দিয়ে দিন।
আবু বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর ক্বছম! আমি জানি না, রসূলুল্লাহ (সা.) কে কী বলব। এরপর আমি আমার আম্মাকে বললাম, আপনি রসূলুল্লাহ (সা.) কে উত্তর দিয়ে দিন। আমার মা বললেন, আল্লাহর ক্বছম! আমি জানি না। রসূলুল্লাহ (সা.) কে কী বলব। অতঃপর আমিই বললাম, আমি অল্প বয়ষ্কা একটি মেয়ে, আমি বেশি কুরআন পড়তেও পারি না। আল্লাহর ক্বছম! আমি জানি, আপনারা এই যে কথা শুনেছেন, এই কথা আপনাদের মনে বসে গেছে এবং এটাকে সত্য মনে করছেন। কাজেই আমি যদি আপনাদের বলি যে, আমি পবিত্রা (নির্দোষ) তবে আপনারা আমাকে সত্যায়ন করবেন না। আর যদি আমি আপনাদের নিকট কোনো কিছু স্বীকার করি Ñঅথচ আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, আমি সে ব্যাপারে পবিত্রা ও নির্দোষÑ তখন আপনারা আমাকে সত্যায়ন করবেন। কাজেই আল্লাহর ক্বছম! আমি আমার নিজের ও আপনাদের উপমা হযরত ইউছুফ (আঃ) এর পিতার মতই দেখছি; তিনি বলেছিলেন, فَصَبْرٌ جَمِيْلٌ অর্থাৎ এখন ছবর করাই আমার জন্য শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউছুফ, আয়াত নং ১৮)
এরপর আমি অন্যদিকে ফিরলাম ও বিছানার উপর শুয়ে পড়লাম। আল্লাহই জানেন আর আমিও জানি যে, আমি নির্দোষ। আল্লাহ নিঃসন্দেহে আমার নির্দোষ ঘোষণা করে দিবেন। কিন্তু আল্লাহর ক্বছম! আমি ধারণাও করতে পারিনি যে, আল্লাহ আমার শানে ওহী নাযিল করবেন। আমার ব্যাপারে তো আমার ধারণা ছিল যে, আমার বিষয়ে আল্লাহ কথা বলবেন!Ñআমিতো একটা নিকৃষ্ট (আমিতো এর উপযুক্ত নই) বরং আমি আশা করতাম, আমার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা রসূলুল্লাহ (সা.) কে কোনো স্বপ্নের মাধ্যমে আমার পবিত্রতা জানিয়ে দিবেন। আল্লাহর ক্বছম! রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর মসলিস থেকে তখনও ওঠেননি, ঘরের লোকেরা কেউ ঘর হতে বের হয়ে যাননি, ইতিমধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর উপর ওহী নাযিল করলেন। ওহীর কারণে রসূলুল্লাহ (সা.) এর কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁর এই ঘাম শীতের দিনের শিশিরের (মুক্তার) মত মনে হচ্ছিল।
আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, এরপর হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) হতে কষ্টের রেখা কেটে গেল। তিনি হাসছিলেন। তিনি প্রথমেই বললেন, হে আয়িশা! শুনে রাখো, আল্লাহ তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন। আমার আম্মা আমাকে বললেন, তাঁর নিকট যাও। আমি বললাম, আমি তাঁর নিকট যাবো না। কেননা আমি শুধু আল্লাহরই প্রশংসা করব। আম্মাজান হযরত আয়িশা সিদ্দীকাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা, সূরা নুরের আয়াত নাযিল করেন।
إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ —— وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (النور 11)
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমি এখন থেকে আর কখনও মিসতাহকে সাহায্য করব না। হযরত আবু বকর (রাঃ) তার আত্মীয়তা ও দারিদ্রের কারণে তার জন্য অনেক খরচ করতেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করলেন,
وَلَا يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ أَنْ يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبَى وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (النور22 (
এরপর হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন আল্লাহ তায়ালার এই আয়াতের কথা শুনলেন,“তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেন” (সূরা নুর,আয়াত নং ২২) তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর ক্বছম! আমি আল্লাহর ক্ষমাকে পছন্দ করি। এরপর তিনি মিসতাহের উপর আবার খরচ করতে লাগলেন এবং বললেন, আমি কখনও তার জন্য খরচ করা বন্ধ করব না। এরপর হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) ঘটনা আলোচনা করলেন এবং কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন। (তাফছীরে লুবাব অবলম্বনে)